A place of faith, devotion, and community
প্রথমের দিকে গ্রামের সরল মানুষেরা প্রত্যেকে নিজের মতো করে ঈশ্বর বন্দনা করতেন। স্বাভাবিক নিয়মেই একে অপরের দেখাদেখি ধীরে ধীরে পাশাপাশি বেশ কয়েকজন মিলে একসাথে হরিনাম করতে আরম্ভ করেন। তাদের মধ্যে শচীন্দ্রনাথ মন্ডল, কানাইলাল মন্ডল, বলাই চন্দ্র মন্ডল, কেশবচন্দ্র মন্ডল, বেচারাম মন্ডল, যতীন্দ্রনাথ বাগ, মহানন্দ পাল, তিলক চন্দ্র পাল, বেচারাম দাস, সাধন চন্দ্র দাস প্রমুখ ব্যক্তিরা নাম সংকীর্তন একসাথে করবার জন্য বিশেষ আগ্রহ দেখান। কালক্রমে তারা একসাথে একটি হরিনাম-সংকীর্তন এর দল খুলে ফেলেন। সেটা বাংলার ১৩৬৭ সাল নাগাদ। সেই সময়ে বাঁশ ও খড় কাদা দিয়ে একটি মন্দির নির্মাণ করা হয়। হরিনাম সংকীর্তন চলতে চলতে নিয়ম করে বছরে একদিন ভোগের আয়োজন করা হতো। আস্তে আস্তে যেমন করে ছোট চারা গাছ মহীরুহে পরিণত হয় তেমনই ওই ভোগ অনুষ্ঠান মহোৎসবের রূপ নেয় । এই যে বাৎসরিক ছোট ভোগের অনুষ্ঠান - এটা যখন আস্তে আস্তে মহোৎসবে পরিণত হয় তাকে সঙ্গ দিয়েছিলেন গ্রামের প্রতিটি মানুষ। সেই থেকে নিয়ম করে প্রতিবছর বৈশাখ মাসের ১৩ থেকে ১৭ তারিখ পর্যন্ত খুব ধুমধাম করে ভোগমহোৎসব পালন করা হয়। ১৩ তারিখে অধিবাস হয়। তারপর ১৪ই ১৫ই ও ১৬ই বৈশাখ এই তিন দিনব্যাপী - ২৪ প্রহর - হরিনাম সংকীর্তন এবং ১৭ তারিখে ভোগ মহোৎসব পালিত হয়। বলা বাহুল্য - গ্রামের সমস্ত মানুষকে বা পাশাপাশি সমস্ত গ্রামের মানুষকে এই অনুষ্ঠানে সাথী করে তোলার জন্য বিশেষ করে যাদের নাম আগে বলেছি তারা ছাড়া অন্যান্য আরো অনেকে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছেন । সময় যতই এগিয়ে চলতে থাকলো তখন ভক্তের সংখ্যা আরো বাড়তে লাগলো। তাদের মধ্যে এই মন্দিরের উন্নতিকল্পে ব্যক্তিগতভাবে যেটুকু দান করা সম্ভব তাই করতে লাগলো। বেশ কয়েকজন ভক্ত যাদের পাশাপাশি জমি ছিল- প্রত্যেকে নিজস্ব সাধ্যমত একটু একটু করে জমি দান করেন। মন্দির নির্মাণকল্পে কানাইলাল বাগ দুই শতক, উপেন্দ্রনাথ বেরা এক শতক, লক্ষ্মীকান্ত দাস দু শতক, ক্ষিতীশ চন্দ্র সাহা ছয় শতক জমি দান করেন। ওই জমিতে তেঘরী নিবাসী স্বর্গীয় দুলাল চন্দ্র আদক মহাশয়ের আর্থিক সহায়তায় পাকা মন্দির নির্মান হয়। এভাবে চলতে চলতে প্রাকৃতিক কারণে দুলাল বাবুর নির্মাণ করা মন্দিরের ছাদ খারাপ হয়ে যায়। অতঃপর ইংরেজি ২০০০ সাল নাগাদ তাঁর পুত্র সৃষ্টিধর আদক ওই মন্দিরকে পুনঃনির্মাণ করে দেন। হরিনাম সংক্রান্ত কার্যকলাপ, মন্দিরের ভোগ মহোৎসব, তার হিসাব নিকাশ ইত্যাদি সঠিকভাবে এবং সুঠামভাবে করার জন্য ১৯৭৮ সালে একটি সমিতি তৈরি করা হয়। সমিতির প্রথম সম্পাদক ছিলেন শচীন্দ্রনাথ মন্ডল। সভাপতি হন বেচারাম দাস। সমিতির সক্রিয় সদস্য হিসেবে কাজ করতেন অনেকেই। তাদের মধ্যে কিছু মানুষের নাম উল্লেখ করা হলো। যেমন – বেচারাম মন্ডল, বিজয় মন্ডল, তারাপদ মন্ডল, অজিত মন্ডল, কার্তিক মন্ডল, দেবেন্দ্রনাথ মন্ডল, সুধীরচন্দ্র মন্ডল, অজিত মন্ডল পূর্ণচন্দ্র মন্ডল, ভুবন চন্দ্র মন্ডল, জিতেন্দ্রনাথ মন্ডল, রবীন্দ্রনাথ মণ্ডল, নিমাই মন্ডল, বাসুদেব বাগ, জয়দেব বাগ, দুঃখীরাম বাগ, পদ্মলোচন বাগ, সনাতন বাগ, বিষ্টু চরণ বাগ, গোঁড়েশ্বর বাগ প্রমূখ। এখানে একটি কথা স্পষ্ট করে স্বীকার করা যায় যে যাদের নাম উল্লেখ করা হলো তারাই শুধুমাত্র কাজ করতেন এমন নয়। এছাড়া পাশাপাশি বেশ কয়েকটি গ্রামের লোকজন নিঃস্বার্থভাবে, খুব ভক্তিভরে মন্দিরের কাজে অংশগ্রহণ করতেন। যাদের নাম বলা হলো না বা নাম উল্লেখ করা হলো না তার অর্থ এই নয় যে তারা কম কাজ করতেন। প্রত্যেকে নিজ নিজ সময় সুযোগ মতো মন্দিরের জন্য নিজেদের মহামূল্য সময় এবং শ্রম দান করেছেন। যার কারণে পুরনো সেই খড়ের চালের মন্দির থেকে আজ বড় মন্দির রূপ পেয়েছে। প্রত্যেক বছর হরিবাসর সমিতির পক্ষ থেকে ভোগ মহোৎসব এর আগে পাড়ায়-পাড়ায়, গ্রামে-গ্রামে ভিক্ষা করে চাল-নারকেল, টাকা-পয়সা সংগ্রহ করতে বের হয়। তা দিয়ে হরিনাম সংকীর্তন এর দল ভাড়া করা ও ভোগ মহোৎসবের আয়োজন করা সম্ভব হয়। কালের গতিতে প্রবীণদের সাথে সাথে নবীনরাও মন্দিরের কাজে হাত লাগাতে আরম্ভ করেন। ওই নবীনদের মধ্যে থেকে দুজন হরিপাগল - তাপস অধিকারী ও শিবুপদ মন্ডল দুজনে অভিনব এবং আধুনিক মন্দির নির্মাণের ও বিগ্রহ স্থাপনের স্বপ্ন দেখতে আরম্ভ করেন। সেই উদ্দেশ্যে ইঞ্জিনিয়ার ও রাজমিস্ত্রির সঙ্গে কথা বলে জানা গেল বহু টাকা দরকার। কিন্তু তাদের কাছে কোন টাকা-পয়সার সম্বল ছিল না । তখন চলছে বাংলা ১৪১৫ সাল। বিশেষ উল্লেখের বিষয় যে, তাদের কাছে কোন টাকা-পয়সা ছিল না বটে , কিন্তু ছিল মহাপ্রভুর প্রতি অগাধ ভক্তি এবং নিজেদের উপর ছিল প্রচন্ড বিশ্বাস আর ছিল ভক্তদের উপর অপরিসীম ভরসা। তারা ক্রমে ক্রমে তাদের এই স্বপ্নকে সমস্ত সদস্যদের মাঝে এবং অন্যান্য ভক্তদের মনের মধ্যে ছড়িয়ে দেন। নতুন মন্দির নির্মাণের ধারণায় সহমত প্রকাশ করে শান্তনু মণ্ডল এবং ডাক্তার নিমাই মন্ডল ওই দুই হরি-পাগলের সাথে একযোগে মন্দির নির্মাণের জন্য ভক্তদের কাছ থেকে টাকা পয়সা ও অন্যান্য দান সংগ্রহ করার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। মন্দিরের জন্য ভক্তবৃন্দের মধ্যে অনেকে সিমেন্ট দিয়েছেন, অনেকে বালি দিয়েছেন, অনেকেই টাইলস দিয়েছেন, কেউ লোহার রড দিয়েছেন, শ্বেত পাথর দিয়েছেন, কেউকে বিগ্রহ পর্যন্ত দান করেছেন। যিনি যেমনভাবে পেরেছেন তেমনভাবে দান করেছেন বলেই গৌরিবাটি হরিবাসর সমিতি সেই ১৪১৫ সালে আরম্ভ করে আজ মন্দির নির্মাণের কাজ শেষের পথে নিয়ে যেতে পেরেছে।